আজ কে বুক টা কেমন ভারী লাগছে দেখে এজমার টান শুরু হওয়ার আগেই চাইছিলাম পিঠা বানানোর কাজ টা শেষ করতে। শীত এলে এই এক সমস্যা। সারা বছর না হলেও এই শীতে প্রতি সন্ধ্যায় শ্বাসকষ্ট হয় ই। আর কাজের চাপ হলে ত কথায় নেই। আজ শাশুড়ি মা বানাতে বললো কলা পিঠা, সকালে নাস্তা র সময় করেছিল ভাপা। গত ৪ দিন ধরে এটাই এ বাসার রুটিন, কারন আমার তিন ননদ বাপের বাড়ি আসছে শীতের ছুটি কাটাতে, আর শীত মানেই ত পিঠা। মেয়েরা বাপের বাড়ি এলে যেকয়দিন ই থাকে প্রতিদিন ২/৩ আইটেম পিঠা করতে হয়। গত সাত বছর ধরে এমনটাই দেখে আসছি। এখনও স্পষ্ট মনে আছে বিয়ের প্রথম বছর একদিনে কলাপিঠা আর মাংসের সমুচা সকালের নাস্তার টেবিলে দেখে মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলাম সকালে ঝাল আর মিষ্টি একসাথে খেলে ত এসিডিটি হবে। সাথে সাথে শাশুড়ি ননদদের মুখ পুরা কালো হয়ে গিয়েছিল।তবে সামান্য এ কথার পাওয়ার বুঝতে পেরেছিলাম বিকালে, যখন মাসুদ এসে বললো রিনি চলো আম্মার কাছে মাফ চাইবে। কারন ওর মা বোন নাকি মনে করছে আমি বোনদের আসা কে পছন্দ করিনি। ছোট ননদটা আরো দুধাপ এগিয়ে বলছে এ বছর ই নাকি তাদের শেষ পিঠার দাওয়াত। বাকরুদ্ধ হয়ে মাফ চাইতে রাজি হলেও শেষ পর্যন্ত আমার শশুর আর এটা হতে দেয়নি। এর পর থেকে আমি আর কোনদিন এসব বিষয়ে বিশেষ করে পিঠার ব্যাপারে কোন কথা বলিনি।কখনও কখনও শরীর মন সায় না দিলেও চুপটি করে শশুড় বাড়ির পিঠা উৎসব পালন করে গেছি।
৫ ভাইবোনের মধ্যে আমি সবার ছোট বলে ই হয়ত আমাকে নাইওর নেওয়া বা ঈদে চাঁদে একবেলা দাওয়াত দেওয়ার ব্যাপারে ভাইয়া রা একটু উদাসীন। আসলে আমাদের পরিবারটাই এমন। সেই ছোট বেলা থেকেই আমরা তিন বোনই দেখে আসছি যে ভালো খাওয়া, ভালো পরা কোন কিছুতে মতামত দেওয়া সবকিছুতেই ভাইরা এগিয়ে। আব্বা যতদিন বেঁচে ছিলেন সমতা করলেও আম্মা এটা কোনদিন ই করেন না। তাই আমাদের বাসায় শীত কালে মেয়েদের জন্য পিঠার দাওয়াত আশা করা বোকামী ছাড়া আর কিছু নয়। বড়পা র বিয়ের পরপর দু একবার পিঠার আয়োজন হলেও এখন আর এসব হয় না কারন তখন আমি আর ছোট মিলে সব সামলে নিতাম কিন্তু ভাবীরা আসার পরে আম্মা ছেলে আর বউদের কষ্ট হবে ভেবে এসব বন্ধ করে দিলেন। আমরা তিনবোন ই ব্যাপার টা তে কষ্ট পেলেও মুখ ফুটে কিছু বলি নাই কোনদিন, সেইযে ছোটবেলা থেকেই অভ্যস্ত।কিন্তু তবুও কেন জানি মাঝে মধ্যে মায়ের, ভাইয়ের আদর পাওয়ার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
প্রতিদিন দুএক আইটেম পিঠা বানালেও আমার খাওয়া হয় খুব কম ই। কারন আমি যখন গরম গরম পরিবেশনে ব্যস্ত সবাই তখন খাওয়ায়। তাই প্রায় ই শেষ হয়ে যায় বা কোন কোন দিন এক দুটো আধ ভাঙা পিঠা টেবিলে পরে থাকলেও আমার আর খাওয়ার ইচ্ছে টাই থাকে না। তবে আজ কলা পিঠা বানানোর পরপর ই একটু বাটিতে তুলে রেখে দিলাম শাশুড়ি মার সামনেই। উনিও ভালো করেই জানেন যে আমি এ পিঠা গরম খাই না, আমার পছন্দ বানানোর পরেরদিন যখন সিরা টা ঘন হয়ে জমে যায় তখন একটু দুধ মিশিয়ে।তাই হয়ত সদয় হয়ে কিছু বললেন না আমাকে।
পরেরদিন সকালে যখন পাটিসাপটা করছিলাম হঠাৎ করে শাশুড়ি এসে বললো একটা বক্সে কয়েকটা পিঠা দাওতো, একটা রোগী দেখতে যাব। বক্স নিয়ে ওনার রুমে হাজির হলে মা অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো এক আইটেম নিলে কেমন দেখা যায়? এককাজ কর ঐ বাটির কলা পিঠা টাও আরেকটা বক্সে দিয়ে দাও। মুখে কিছু না বললেও কষ্ট টা আর লুকাতে পারছিলাম না আমি। তাড়াতাড়ি আরেকটা বক্সে কলা পিঠা টা দিয়ে মা কে বললাম আমি বুয়া কে ডাক দিয়ে নিয়ে আসতে যাচ্ছি মা, অন্যদিন সকাল সকাল চলে আসলেও আজ কেন দেরি করছে দেখে আসি। আসলে বুয়া আমাকে বলেই গিয়েছিল আজ একটু দেরি করে আসবে, কারন ওনার মেয়ে ও যে আসছে মা র কাছে। সদ্য পাওয়া কষ্ট আর অপমানটা সইয়ে নিতেই একটু সময় দরকার আমার তাই বুয়ার কথা বলে বের হওয়া।
হাটতে হাটতে বুয়ার বাড়ির সামনে এসে পরেছি। এখান থেকে ই ফিরে যাব ভাবতে ভাবতেই বুয়ার মেয়েটা আমাকে দেখে চিল্লাচিল্লি শুরু করছে আম্মাগো দেখে যাও কে আইছে? বুয়া ও তড়িঘড়ি করে এসে আমাকে দেখে অবাক হয়ে বললো আফা আফনে, কোন জরুরি দরহার? আমি কোন মতে সামলে বললাম না বুয়া, তোমার মেয়ে না আসবে বলেছিলে তাই ওকে দেখতে এলাম।আমার এ সামান্য কথায় বুয়ার পরিবারের সবার উজ্জ্বল মুখগুলো র সামনে আমার কষ্ট, অপমান কে তুচ্ছ মনে হচ্ছিল।যেখানে বসে মাটির চুলাতে বুয়া মেয়ে, জামাই এর জন্য হলুদ পিঠা বানাচ্ছিল আমিও সেখানে গিয়ে বসলাম। বুয়া হরবর করে বলছে আফা গো অনেক কিছুই বানাইতে মন ছায় তয় যোগাড় করতে ফারিনা, এই দেহেন এই হলুদ ফিডায় খরছ কম তাই এডা বানাইতাছি, তয় কাইল রাইতে আরেকপদ বানাইছিলাম, খারান আফনের লাইগগা লয়া আই, খায়া কন কিমুন হয়ছে। আমি জোর দিয়ে না না করছি তবু ও বুয়া ঘরের ভিতরে দৌড় দিল। একটু পরেই একহাতে একটা বাটি আর আরেকহাতে একটা কাপ এনে সামনে রাখলো।অবাক বিস্ময়ে আমি তাকিয়ে দেখি বাটি তে ঘন সিরায় জমে যাওয়া কলা পিঠা আর আধাকাপ দুধ। ঠিক যেমন আমার পছন্দ। জিজ্ঞেস না করে পারলাম না যে তুমি কিভাবে জানলে? পান খাওয়া সবগুলো দাঁত বের করে ওনি বললো ২ বছর দরে আফনের লগে কাম করি এটুক না জানলে হয়বো আফা ? বুয়ার সামনে কাদবো না ভেবে চোখের পানিটা আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছিলাম। আর এদিকে আমার মা, শাশুড়ি সবাই কে পরাজিত করে এ বুয়া আমাকে একটু কাঁদবার সুযোগ করে দিয়ে পানি আনার নাম করে ভিতরে চলে গেলো।
লেখিকা: ফারহানা ববি।